//বিশেষ প্রতিবেদক//
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা সর্বপ্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সবচেয়ে প্রাচীন উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কে ধ্বং-স করেছিলো?
ঐতিহাসিক বিচারে নির্মোহ সত্যান্বেষণ।।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, গুপ্ত সাম্রাজ্য তথা ভারতীয় উপমহাদেশের এক সুপ্রাচীন নিদর্শন এবং প্রাচীন বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয় ৪১৩ খ্রিস্টাব্দে। সেসময় এমন সুসজ্জিত ও পূর্ণাঙ্গ আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব ইতিহাস ঘেটে পাওয়া যায় না। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, সেসময় এই অঞ্চলে গুপ্তদের শাসনামল চলছিল। সেই অনুযায়ী, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সম্রাট কুমারগুপ্তকেই ধরে নেওয়া হয় যা পরবর্তীতে স্কন্ধগুপ্তের হাত ধরে আরও বিস্তৃত হয়। পরবর্তীতে পাল রাজাদের আমলে শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ অগ্রগতি লাভ করে নালন্দা। ধর্মপালের সময়ে বিক্রমশীলা, সোমপুর ও ওদন্তপুরী প্রতিষ্ঠিত হলে তা নালন্দা মহাবিহারের জ্ঞানচর্চার গতিকে আরও ত্বরান্বিত করে৷ পাল রাজাদের আমলে বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাবও বাড়তে থাকে।
নালন্দা ধ্বংসের আদ্যোপান্ত:
জ্ঞানবিজ্ঞানের পীঠস্থান নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বহি:শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে একাধিকবার তবে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ একবার-ই হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় উল্লেখযোগ্য তিনটি আক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যানুযায়ী নালন্দা প্রথম আক্রান্ত হয় মিহিরকুলের নেতৃত্বে হুনদের দ্বারা, তারপর আক্রান্ত হয় বঙ্গাধীপতি শশাঙ্কের সেনাবাহিনী দ্বারা এবং পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় আফগান দস্যু বখতিয়ারের সেনাবাহিনী দ্বারা।
চলুন এবার ধারাবাহিক তথ্য বিশ্লেষণ করি। আমাদের মূল অভিপ্রায় থাকবে মোটামুটি প্রাইমারি সোর্স থেকেই সত্যানুসন্ধান করার।
১/ হুনদের দ্বারা আক্রান্ত: প্রথমবার নালন্দা আক্রান্ত হয় গুপ্ত সম্রাট স্কন্দগুপ্তের সময়ে। হুনরা মিহিরকুলের নেতৃত্বে ৪৫৫-৪৫৬ খ্রিষ্টাব্দে নালন্দা আক্রমণ করেছিলেন। সেই সময় শক, হুন, ইত্যাদি বহিরাগতরা প্রায়শই ভারত আক্রমণ করত। তবে স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী রাজারা নালন্দাকে পুনরায় নির্মাণ করে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন। কারণ তিব্বতীয় চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং (জুয়ানযাঙ্গ) সপ্তম শতকে যখন ভারত ভ্রমণে আসেন তখন নালন্দা হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষকে পরিপূর্ণ ছিলো।
২/ বঙ্গাধীপতি শশাঙ্ক দ্বারা আক্রান্ত: দ্বিতীয়বার নালন্দা আক্রান্ত হয় বঙ্গাধীপতি শশাঙ্কের সেনাবাহিনী দ্বারা৷ সম্ভবত বঙ্গরাজ শশাঙ্ক মগধ আক্রমণের সময় নালন্দা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে নালন্দা ধ্বংস হয় নি। তাছাড়া শশাঙ্কের উদ্দেশ্যও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা ছিলো না। যদি তা-ই হতো তবে বঙ্গের রাজধানী কর্ণসুবর্ণের নিকটে “রক্তমৃত্তিকা” মহাবিহারও ধ্বংস করে দিতেন। সপ্তম শতকেই ভারতে আসেন তিব্বতীয় চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ (জুয়ানযাঙ্গ) এবং শীলভদ্রের অধীনে পড়াশোনাও করেন। তাঁর বর্ণনায় পাওয়া যায় সেসময় নালন্দার ১০০টি শ্রেণিকক্ষে প্রায় ২,০০০ শিক্ষকের অধীনে ২০,০০০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতো। হিউয়েন সাং ভারত থেকে ফেরার সময় শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ তে যান এবং এর পর উড়িষ্যা দিয়ে চীনে ফিরে যান। শশাঙ্ক যদি বৌদ্ধ বিদ্বেষী হতেন তবে হিউয়েন সাং কর্ণসুবর্ণে প্রবেশ করতে পারতেন না। উল্লেখ্য যে শশাঙ্ক যদি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসই করে দিতেন তবে হিউয়েন সাং ভারত থেকে ফেরার সময় ছয় শতাধিক ভারতীয় গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি নিয়ে যেতে পারতেন না। স্যামুয়েল বিল হিউয়েন সাঙের মূল রচনার ইংরেজি অনুবাদ করে “Si-Yu-Ki: Buddhist Records of the Western World” নামে প্রকাশ করেন। তাছাড়া বঙ্গাধীপতি শশাঙ্ক নালন্দা আক্রমণ করেছেন এমন কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না প্রাথমিক সোর্স থেকে।
৩/ আফগান দস্যু বখতিয়ারের সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত: তৃতীয় আক্রমণ তথা ভয়ংকর ধ্বংসলীলা সংগঠিত হয়েছিল তুর্কী দস্যু বখতিয়ারের সেনাবাহিনী কর্তৃক। নালন্দা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, প্রচুর পুস্তক ও ভিক্ষুদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। কিছু ভিক্ষু তিব্বত/নেপালে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। এই জন্যই বাংলার প্রাচীনতম পুস্তক চর্যাপদ বাংলা/বিহারে পাওয়া যায় না; চর্যাপদ উদ্ধার করা হয় নেপাল থেকে। তুর্কী দস্যু বখতিয়ারের সেনাবাহিনী যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুড়িয়েছিলো তার প্রমাণ মোটামুটি সকল প্রাথমিক সোর্স থেকেই পাওয়া যায়।
★ বখতিয়ার খিলজির সেনাবাহিনীর হাতেই যে নালন্দা মহাবিহার ধ্বংস হয়েছিলো তার প্রমাণ হিসেবে ফারসি ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ তাঁর তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থেই নথিভুক্ত করেছিলেন। এই বইটি ত্রয়োদশ শতকে রচিত, পরবর্তীতে ১৮৭৩ সালে সেটা মেজর এইচ.জি. রাভেট্রি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। মিনহাজ লিখেছেন,
“মুহাম্মদ-ই-বখত-ইয়ার দুর্গটি দখল করে এবং ভীষণ লুট করে। সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা ছিলো ব্রাহ্মণ এবং সকলের মাথা ছিলো মুণ্ডিত যাদের সবাইকেই হত্যা করতে৷ সেখানে বিশাল সংখ্যক পুস্তক ছিলো৷ যখন সবগুলো বই মুসলমানদের হাতে এলো এই বিষয়ক তথ্যের জন্য অনেক হিন্দুদের আনা হলো এবং সবাইকে হত্যা করা হলো। পরে, জানা গেলো এই দুর্গ এবং শহরটি ছিলো একটি কলেজ এবং হিন্দু ভাষায় এই কলেজকে বিহার বলা হতো৷ সেখানকার হাজার হাজার সন্ন্যাসীকে পুড়িয়ে মারা হলো এবং জীবতদের শিরোচ্ছেদ করা হলো। খিলজি তলোয়ারের মুখে বৌদ্ধদের উৎখাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো৷ সেখানকার লাইব্রেরি মাসব্যাপী পুড়েছিলো এবং দগ্ধ পুস্তকের ধোঁয়ায় আশেপাশের পাহাড়গুলো অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো।”
★ দ্বিতীয় সোর্স হিসেবে রয়েছে সুব্রহ্মণ্য রচিত “নালন্দাদহন” নাটিকা। তিব্বতীয় বজ্রযানী বৌদ্ধদের শাস্ত্র “পিটক” এ এই নাটিকাটি সংকলিত আছে। বজ্রযানী সকল পিটক উরগ্যেন লিংপার হাত ধরেই পূর্ণতা পেয়েছিলো। উরগ্যেন লিংপা বহু হারিয়ে যাওয়া শাস্ত্রগ্রন্থের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে সংকলন করতেন, তিনি চতুর্দশ শতকের ব্যক্তি। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে “নালন্দাদহন” নাটিকাটি অবশ্যই ত্রয়োদশ শতকের হবে যা প্রাথমিক সোর্স হিসেবে গ্রহণ করা যায়। নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যায়, তুরষ্ক সেনাসমুদ্র নালন্দার রাজদ্বারে প্রবেশ করিল। তাহাদিগের যত অশ্বারোহী তরবারির অগ্রে ভিক্ষুদের কাটিতে ও পুড়াইতে লাগিল।
এক বরিষ্ঠ ভিক্ষু সেই ঘোর জঘন্য কার্য্যের বর্ণনা করিলেন : —
“তুরষ্কবর্গ বায়ুবেগে আসিল এবং তদীয় শত্রু চূর্ণ করিতে লাগিল। সহস্র সহস্র ভিক্ষুকে কাটিয়া তাহারা যেন হত্যাযজ্ঞব্রত ধারণ করিয়াছে।”
সেনাপতি পুস্তকালয় দহনে উদ্যত দেখিয়া পুস্তকালয়ের অধ্যক্ষা ভিক্ষুণী ভাগেশ্বরী তাঁর কাছে প্রার্থনা করিলেন : —
“হে মহামতি মহাসেনাপতি! পুড়াইও না! শত সহস্র বিদ্বানের সাধনধনসঞ্চিত এই জ্ঞানভাণ্ডার পুড়াইও না। আমরা স্বল্পায়ু মানুষ, সাধনও স্বল্প; তথাপি কোটি কোটি জ্ঞাননিমগ্ন বিদ্বানের জ্ঞান দ্বারা বর্ধিত এই ভাণ্ডার অখিলহিতকারী। তোমাদিগের দেশের পণ্ডিতরাও এইসকল খণ্ডন করিতে পারেন। এ যে শাস্ত্রের অকৃত্রিম ভাণ্ডার!”
(নাটিকার অনুবাদক: Koyel Writes)
★ তৃতীয় সোর্স হিসেবে আচার্য ধর্মস্বামীর বায়োগ্রাফি ব্যবহার করা যায়। উনার বায়োগ্রাফী “Upasaka Chos-dar” এর মূল তিব্বতীয় পাণ্ডুলিপি ইংরেজি অনুবাদ করেন Dr. George Roerich যেটা ১৯৫৯ সালে জয়সাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পাটনা থেকে প্রকাশিত হয়। ধর্মস্বামী ১২৩৩/১২৩৪ সালে ভারতে আসেন এবং ওদন্তপুরীতে গিয়ে দেখেন সেটা একজন তুর্কী (এক আফগান সম্প্রদায়) সেনা কমান্ডারের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তুর্কী সেনারা বিক্রমশীলা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। তুর্কীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নালন্দার ৮০টি ছোট বিহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয় রাজা বুদ্ধসেনার অর্থায়নে মাত্র দুটো বিহারের কার্যক্রম চলমান ছিলো। এগুলো পরিচালনা করতেন ৯০ বছর বয়স্ক সন্ন্যাসী রাহুল শ্রীভদ্র, আচার্য ধর্মস্বামী উনারই শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আচার্য ধর্মস্বামী চাগ লোতস্বা নামেও পরিচিত ছিলেন।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বখতিয়ার খিলজির সেনাবাহিনী দ্বারাই নালন্দার বড় বড় বিহারগুলো ধ্বংস হয় এবং খিলজি মারা যাওয়ার পরও তুর্কী সেনাবাহিনী নালন্দার সম্পূর্ণ এলাকা দখল করে রেখেছিলো। অনেকে বলার চেষ্টা করে তুর্কী আক্রমণের পরও নালন্দা টিকে ছিলো। আচার্য ধর্মস্বামী ১২৩৩/১২৩৪ সালে যখন নলন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণে আসেন তিনি দেখেন যে ৯০ বছর বয়স্ক রাহুল শ্রীভদ্র মাত্র ৭০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শ্রেণিকক্ষ পরিচালনা করছেন। তার উপস্থিতিতেই তুর্কী সৈন্যদের দ্বারা নালন্দা আবার আক্রান্ত হয় এবং সকল শিক্ষার্থী পলায়ন করে।
মন্তব্য: এই ছিলো মোটামুটি নালন্দা ও তার পার্শ্ববর্তী বিহারগুলোর ধ্বংসের প্রাথমিক ইতিহাস যেখানে ঘুরেফিরে বখতিয়ার ও তার সেনাবাহিনী এবং তার উত্তরসূরীদের জড়িত থাকার ইতিহাস স্পষ্ট। অনেকে বলে নালন্দা মহাবিহার কেবল বৌদ্ধ স্থাপনা, হিন্দুদের কোন অধিকার নেই। অথচ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় হিন্দু রাজা কুমারগুপ্তের সময় এবং নালন্দা চুড়ান্ত উৎকর্ষতা লাভ করে স্কন্দগুপ্তের হাত ধরে। পরবর্তীতে অষ্টম শতকে পাল রাজা ধর্মপাল আরও কিছু বিহার স্থাপন করে নালন্দাকে আরও বিস্তৃত করার চেষ্টা করেছেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নালন্দায় রাখা হিন্দু দেববিগ্রহগুলোরও অনাদর করতেন না। নালন্দার প্রত্নতাত্ত্বিক খননে গণেশ, চামুণ্ডা, উমা-মহেশ্বর, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, বুদ্ধ ও সূর্য বিগ্রহ পাওয়া যায়। কলমে: অনিক কুমার সাহা